চাঁদে কি আসলেই জমি কেনা যায়

 






যেমন ভাবনা তেমন কাজ। পরিকল্পনা অনুযায়ী ডেনিস হোপের লুনার এমবাসিতে চাঁদে জমি কেনার জন্য আবেদন করেন অসীম। ২০ সেপ্টেম্বর জমির কাগজ ই–মেইলের মাধ্যমে তাঁকে পাঠানো হয়। জমি কেনার পর তাঁকে একটি বিক্রয় চুক্তিনামা, কেনা জমির একটি স্যাটেলাইট ছবি, জমিটির ভৌগোলিক অবস্থান এবং মৌজা-পর্চার মতো আইনি নথিও পাঠিয়েছে লুনার এমবাসি।

অসীমের স্ত্রী ইসরাত টুম্পা বলেন, ‘চাঁদের দেশে এক টুকরো জমি উপহার পেয়ে আমি দারুণ খুশি। উপহারটি পাওয়ার পর আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন স্বপ্নের চাঁদে চলে গেছি।’

অসীম–টুম্পার এই ভালোবাসা, বন্ধন ও উচ্ছ্বাসে হয়তো খাদ নেই, তবে আমাদের একটা প্রশ্ন আছে। প্রশ্নটা হলো—

চাঁদে কি আসলেই জমি কেনা যায়

চাঁদের বুকে পা রেখেছেন বাজ অলড্রিন
চাঁদের বুকে পা রেখেছেন বাজ অলড্রিন
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

সেই ১৯৬৯ সালে নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন চাঁদের বুকে অবতরণ করেন। চাঁদের বুকে সেবারই প্রথম মানুষের পদচিহ্ন পড়েছিল। তারপর ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আরও কয়েকটি অভিযানে মানুষ চাঁদের বুকে অবতরণ করেছিল। কিন্তু ১৯৭২ সালের পর থেকে আর কোনো মানুষ চাঁদে অবতরণ করেনি। তবে সেই পরিস্থিতি বুঝি দ্রুতই শেষ হতে চলেছে। চীন বেশ কয়েক বছর ধরেই চাঁদের পানে হাত বাড়িয়ে চলেছে। ২০১৩, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে চীন চাঁদে সফলভাবে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করেছে। চাঁদের দিকে নজর আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও জাপানেরও।

সেই স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা যখন চাঁদের বুকে প্রথম মনুষ্যবাহী যান পাঠানোর পরিকল্পনা করছিল, তখন জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য ‘আউটার স্পেস ট্রিটি’ নামের এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।

১৯৬৭ সালে ‘আউটার স্পেস ট্রিটি’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেন  যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধিরা
১৯৬৭ সালে ‘আউটার স্পেস ট্রিটি’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধিরা
ছবি: জাতিসংঘ

ওই চুক্তিতে বলা হয়, কোনো নির্দিষ্ট দেশ চাঁদসহ মহাকাশের অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের সার্বভৌমত্ব বা মালিকানা দাবি কিংবা কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ১১১টি দেশ এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।

চুক্তিটিকে মহাকাশের ‘ম্যাগনাকার্টা’ হিসেবে অভিহিত করেন অনেকে। এই চুক্তির কারণেই চাঁদের বুকে পতাকা উড়িয়েই যে কেউ এর মালিকানা দাবি করতে পারে না। কিন্তু ১৯৬৭ সালের চুক্তিতে চাঁদের ভূমির ওপর ব্যক্তিগত ও করপোরেট অধিকার নিয়ে কিছু বলা হয়নি। ফলে আসলেই যদি ধনী কোনো ব্যক্তি চাঁদের বুকে একখণ্ড জমি কিনতে চায়, তার বেলায় কী হবে, সেটি অস্পষ্ট থেকে যায়। এখানে আইন বিশেষজ্ঞরা দুই রকম ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, সম্পত্তির অধিকার দাবি করতে হলে সেই সম্পত্তি হতে হবে কোনো নির্দিষ্ট দেশের সীমানার ভেতরে। আবার কেউ কেউ বলছেন, সম্পত্তির অধিকার এবং সার্বভৌমত্ব কোনো ভৌগোলিক সীমানার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

১৯৬৯ সালে চাঁদের মালিকানা এবং খননস্বত্ব খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু প্রযুক্তি যতই উন্নত হচ্ছে, চাঁদ ততই মানুষের নাগালের মধ্যে আসছে আর এসবের গুরুত্ব ততই বাড়ছে। ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে ‘মুন অ্যাগ্রিমেন্ট’ নামে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে বলা হয়, পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহটিকে শুধু বিশ্ববাসীর শান্তির স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে এবং চাঁদে যদি কেউ কোনো স্টেশন স্থাপন করতে চায়, তাহলেও জাতিসংঘকে আগে জানাতে হবে।

মুন অ্যাগ্রিমেন্টে বলা হয়, ‘চাঁদ এবং এর প্রাকৃতিক সম্পদের সাধারণ উত্তরাধিকার সমগ্র মানবজাতি’ এবং কেউ যদি এসব সম্পদের অপব্যবহার করে, তাহলে তা প্রতিহত করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক শাসনব্যবস্থা তৈরি করা হবে। মুন অ্যাগ্রিমেন্টে যেহেতু চাঁদের উত্তরাধিকার হিসেবে ‘সমগ্র মানবজাতির’ কথা বলা হয়েছে, তাই অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে চাঁদে ব্যক্তিগত ও করপোরেট মালিকানা নিষিদ্ধ।

ওই চুক্তিতে বলা হয়েছে, চাঁদের কোনো খনিজ সম্পদের উত্তোলন এবং রক্ষণাবেক্ষণ একটি স্পেস ওয়াচডগ বা নিয়ন্ত্রকের অধীনে হতে হবে এবং এ থেকে যা লাভ হবে, তার একটা অংশ তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দেওয়া হবে। এই চুক্তিতে চাঁদে কোনো ধরনের অস্ত্র পরীক্ষাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ‘কমার্শিয়াল স্পেস লঞ্চ কমপিটিটিভনেস অ্যাক্ট’ নামের এক আইন পাস করে। যার ফলে মার্কিন নাগরিকেরা মহাকাশের এমন যেকোনো কিছুর মালিকানা নিতে পারবে, যেখানে তারা পানি এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদের জন্য খননকার্য পরিচালনা করতে পারবে।

কিন্তু এই চুক্তির দুর্বলতা হচ্ছে, মাত্র ১১টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছে। স্বাক্ষরকারী দেশের তালিকায় আছে ফ্রান্স এবং ভারত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও চীনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো এই চুক্তিকে অনুমোদন দেয়নি। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রথম দিকে মুন অ্যাগ্রিমেন্টে স্বাক্ষর করবেন ভাবা হলেও চুক্তির ভাষা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে তিনি আর স্বাক্ষর করেননি। কিন্তু চাঁদের মতো অন্য গ্রহ-উপগ্রহগুলো রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানায় যাওয়া ঠেকাতে যে চুক্তিগুলো বর্তমানে কার্যকর আছে, সেগুলো কয়েক বছর ধরেই হুমকির মুখে পড়েছে।

২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ‘কমার্শিয়াল স্পেস লঞ্চ কমপিটিটিভনেস অ্যাক্ট’ নামের এক আইন পাস করে। যার ফলে মার্কিন নাগরিকেরা মহাকাশের এমন যেকোনো কিছুর মালিকানা নিতে পারবে, যেখানে তারা পানি এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদের জন্য খননকার্য পরিচালনা করতে পারবে। এই আইনের কারণে মার্কিন নাগরিকেরা মূলত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মহাকাশকে ব্যবহারের অনুমতি পায়। যদিও চাঁদকে এই আইনের বাইরে রাখা হয়েছে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে চাঁদও যে এমন কোনো আইনের অন্তর্ভুক্ত হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

চাঁদ ক্রশম মানুষের নাগালের মধ্যে আসছে
চাঁদ ক্রশম মানুষের নাগালের মধ্যে আসছে
ছবি: পেক্সেলস

২০১৭ সালে লুক্সেমবার্গও একই রকম একটি আইন প্রণয়ন করেছে। যেখানে সে দেশের নাগরিকদের মহাকাশে থাকা সম্পদের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার সুযোগ রাখা হয়েছে। দেশটির তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী এতিয়েন স্নাইডার আইনটি সম্পর্কে বলেছিলেন, এটি তাঁর দেশকে এই খাতে ইউরোপের মধ্যে পথপ্রদর্শকে পরিণত করল।

তাহলে শেষ কথা কী দাঁড়াল? জাতিসংঘের ‘আউটার স্পেস ট্রিটি’ চুক্তি অনুযায়ী, চাঁদে কেউ জমি কিনতে পারে না। তবে কিছু দেশের নাগরিক আইন বা চুক্তির ফাঁকফোকর বের করে চাঁদ এবং অন্যান্য গ্রহ–উপগ্রহে জমি বিক্রির নাম করে পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। যাঁরা কিনছেন, তাঁরা আসলে প্যাকেটভর্তি বাতাসই কিনছেন!

সংগীতশিল্পী অর্ণবের একটা গান আছে, ‘চাঁদ দেখে কেউ থুরথুরে সাত বুড়ো/ চাঁদ দেখে কেউ টাটকা তরুণ খোকা/ চাঁদ দেখে কেউ প্রখর বুদ্ধিমান/ চাঁদ দেখে কেউ ভ্যাবাচেকা কেউ বোকা...’!

সূত্র: বিবিসি ও ইকোনমিক টাইমস

Post a Comment

Previous Post Next Post