অবহেলায় হারিয়ে গেল এক রত্ন

কলসিন্দুর গ্রামটার কথা জানেন না, বাংলাদেশে এমন ক্রীড়াপ্রেমী খুব বেশি একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী এই গ্রামের অদম্য কয়েকজন কিশোরীই দেশের ফুটবলকে এনে দিয়েছে সর্বোচ্চ সফলতা। ২০১৫ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ টুর্নামেন্টের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাজয়ী দলের ১০ জনই ছিল এই গ্রামের মেয়ে। গত বছর এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্ব মাতিয়েছে এখানকার মেয়েরা। ইরান, চায়নিজ তাইপের মতো দেশগুলোকে মাটিতে নামিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে জায়গা করে নেয় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের মূল পর্বে। দেশকে সফলতা এনে দিলেও বারবারই অবহেলিত এই বীর কন্যারা।
গতকাল মঙ্গলবার অবহেলার শিকার হলো সে দলের তারকা ফুটবলার সাবিনা ইয়াসমিন। সম্প্রতি অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল দলে জায়গা পেয়েছিল সে। আজ বুধবার দলের সঙ্গে ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার কথা ছিল তার। তবে সময়মতো ও সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় অকালেই ঝরে গেল বিস্ময়কর এক প্রতিভা।
ময়মনসিংহ থেকে ৭০ ও ধোবাউড়া উপজেলা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে সাবিনা-মার্জিয়াদের কলসিন্দুর গ্রাম। এখানেই কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করে সাবিনা। স্বপ্ন ছিল, অগ্রজদের দেখানো পথ ধরে একদিন জাতীয় দলে খেলবে। তবে সেই স্বপ্নটা পূর্ণ হলো না তার। গত দুদিন জ্বরে ভুগছিল সাবিনা। দরিদ্র পিতা স্থানীয়ভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তবে তাতে কাজ হয়নি। মঙ্গলবার দুপুরের পর সাবিনার অবস্থার অবনতি হয়। আশঙ্কাজনকভাবে তাকে ধোবাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে আসার আগেই অবশ্য শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে সে।
সাবিনার এমন করুণ মৃত্যু বেশ কিছু প্রশ্নকে উসকে দিয়েছে। দুদিন জ্বরে পড়ে থাকার পরও স্থানীয় ফুটবল মহল কেন সাবিনার খোঁজখবর নিল না? ক্যাম্পে ডাক পাওয়া ফুটবলারের খোঁজই বা কেন রাখল না ফুটবল ফেডারেশন।
দেশকে সাফল্য এনে দেওয়া এই সোনার মেয়েরা এর আগেও বেশ কয়েকবার ফুটবল ফেডারেশনের অবহেলার শিকার হয়েছে। গত বছর অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্ব শেষে একটি লোকাল বাসে করে ধোবাউড়ায় ফেরত পাঠানো হয় তাঁদের। অভিভাবকহীন ফুটবলারদের পেয়ে তাদের উত্ত্যক্ত করতে ছাড়েনি অনেকে। এ বছর সিঙ্গাপুর থেকে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলা শেষে দেশে ফিরে ঢাকা থেকে জামালপুরগামী ট্রেনে চেপে ময়মনসিংহে যায় অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবলের তিন তারকা মার্জিয়া, নাজমা ও শামছুন নাহার। এরপর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে স্টেশন থেকে বাসস্ট্যান্ডে যায় তারা। সেখানে ভাড়ায়চালিত সিএনজিচালিত অটোরিকশায় অপর এক যাত্রীর সঙ্গে গাদাগাদি করে বসিয়ে দেওয়া হয় ফুটবলকন্যাদের।
উন্নতির সূচকে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ ফুটবলে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। জাতীয় ফুটবল দলের যা অবস্থা, তাতে করে আর কয়েক দিন পর র্যাংকিংয়ে ২০০তম স্থানে নেমে যেতে হতে পারে। তবে দেশের ফুটবলকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে বয়সভিত্তিক দলগুলো। জাতীয় দল না পারলেও অনূর্ধ্ব-১৬, ১৮ দলগুলো নজরকাড়া সাফল্য দেখিয়ে চলছে। সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবল জয়ের দোরগোড়ায় রয়েছে বাংলাদেশে। অনূর্ধ্ব-১৬ দল হারিয়ে দিয়েছে কাতারের অনূর্ধ্ব-১৬ দলকে। দেশের কিশোরীরা বিদেশ থেকে সুনাম বয়ে আনছে। অথচ তাদের নেই কোনো পরিচর্যা। সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিভা। অবহেলায় আর যেন কোনো সাবিনা না হারিয়ে যায়, সেদিকে এখনই ফুটবল-সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ দেওয়া উচিত।