১. যাকাত দেয়ার সময় হকদারকে বা যাকাত
গ্রহীতাকে একথা বলার প্রয়োজন নেই যে, এ যাকাত। বরঞ্চ উপহার, বাচ্চাদের
জন্যে তোহফা এবং ঈদের উপহার বলে দেয়াও জায়েয। এতটুকু যথেষ্ট যে যাকাত দাতা
যাকাত দেয়ার নিয়ত করবে।
২. শ্রমিককে তার পারিশ্রমিক হিসেবে এবং
কর্মচারী বা খাদেমকে বেতন হিসেবে যাকাত দেয়া জায়েয নয়। তবে বায়তুলমালের
পক্ষ থেকে যেসব লোক যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের জন্যে নিযুক্ত থাকে তাদের বেতন
যাকাতের টাকা থেকে দেয়া যেতে পারে।
৩. বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে অগ্রিম যাকাত
দিয়ে দেয়া জায়েজ এবং মাসিক কিস্তিতে দেয়াও জায়েয এ শর্তে যে দাতা সাহেবে
নেসাব হবে। যদি কেউ এ আশায় অগ্রিম যাকাত দেয় যে, সে সাহেবে নেসাব হয়ে যাবে
তাহলে এমন ব্যক্তির যাকাত হবে না। সে সময়ে সে সাহেবে নেসাব হবে এবং বছর
পূর্ণ হবে তখন তাকে আবার যাকাত দিতে হবে। (বেহেশতি জিওর)
হযরত আলী (রা) বলেন, হযরত আব্বাস (রা) অগ্রিম যাকাত দেয়া সম্পর্কে নবীর কাছে জানতে চাইলে তিনি অনুমতি দেন। (আবু দাউদ, তিরমিযি)
৪. যাকাতে মধ্যম ধরনের মাল দিয়ে দেয়া
উচিত। এটা ঠিক নয় যে, যাকাত দাতা সাধারণ মাল যাকাত হিসেবে দিবে এবং এটাও
ঠিক নয় যে, যাকাত সংগ্রহকারী সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মাল যাকাত হিসেবে নিয়ে নেবে।
দাতা আল্লাহর পথে ভালো জিনিস দেবার চেষ্টা করবে এবং আদায়কারী কারো ওপরে
বাড়াবাড়ি করবে না।
৫. যাকাত যে আদায় করবে (সংগ্রহ করবে) সে
ইচ্ছা করলে যে বস্তুর ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়েছে সে বস্তুত নিতে পারে, যেমন
সোনা অথবা পশু এবং ইচ্ছা করলে তার মূল্যও নিতে পারে। উভয় অবস্থায় যাকাত হয়ে
যাবে। একথা মনে রাখতে হবে মূল্য আদায় করতে হলে তা যাকাত দেবার সময়ে যে
মূল্য হবে তাই আদায় করতে হবে যে সময়ে যাকাত ওয়াজিব হয়েছে সে সময়ের মূল্য
নয়। যেমন মনে করুন এক ব্যক্তি ছাগল প্রতিপালন করে। বছর পূর্ণ হবার পর একটি
ছাগল তার যাকাত ওয়াজিব হয়েছে। এখন তার মূল্য ৫০ টাকা। এখন কোনো কারণে যাকাত
কয়েক মাস বিলম্বে দেয়া হচ্ছে। আর এ সময়ে সে ছাগলটির মূল্য যদি বেড়ে গিয়ে
৬০ টাকা হয় অথবা কমে গিয়ে ৪০ টাকা হয় তাহলে এ ষাট অথবা চল্লিশ টাকা যাকাত
দিতে হবে।
৬. যাকাত ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালেই
জমা হওয়ার কথা। ইসলামী রাষ্ট্রেরই এ দায়িত্ব যে, সে যাকাত আদায় ও বণ্টনের
ব্যবস্থাপনা করবে। যেখানে মুসলমানগণ তাদের অবহেলার কারণে গোলামির জীবন যাপন
করছে অর্থাৎ যেখানে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা নেই, সেখানে মুসলমানদের
কর্তব্য হচ্ছে এই যে, তারা নিজেদের উদ্যোগে মুসলমানদের বায়তুলমাল কর্তব্য
হচ্ছে এই যে, তারা নিজেদের উদ্যোগে মুসলমানদের বায়তুলমাল কায়েম করবে এবং
সেখানে সকল যাকাত নির্দিষ্ট খাতগুলোতে ব্যয় করবে। আর এ ধরনের সামষ্টিক
ব্যবস্থাপনা থেকে যদি মুসলমান বঞ্চিত হয় তাহলে নিজের পক্ষ থেকেই হকদারদের
কাছে যাকাত পৌছিয়ে দেবে এবং অবিরাম শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে এবং বাস্তব
ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা চালাতে থাকবে যাতে করে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম
হয়। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া আল্লাহ তায়ালার বহু নির্দেশ ও আইন
কানুন মেনে চলা কিছুতেই সম্ভব নয়।
৭. যারা সাময়িকভাবে অথবা স্থায়ীভাবে
যাকাতের হকদার যেমন পঙ্গু, রোগী, স্বাস্থ্যহীন ও দুর্বল, গরীব দুস্থ,
মিসকিন, বিধবা, এতিম প্রভৃতি। তাদেরকে সাময়িকভাবেও বায়তুলমাল থেকে সাহায্য
দেয়া যেতে পারে এবং স্থায়ীভাবেও তাদের ভরণ পোষণের অথবা ভাতার ব্যবস্থা করা
যেতে পারে।
৮.বায়তুলমাল থেকে যাকাত হকদার কোনো এক
ব্যক্তিকেও দেয়া যায় এবং কোনো সংগঠন বা সংস্থাকেও দেয়া যায়। স্বয়ং এ ধরনের
কোনো সংস্থাও কায়েম করা যেতে পারে যা যাকাত ব্যয় করার উপযোগী, যেমন
এতিমখানা, দুঃস্থদের জন্যে বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা ইত্যাদি।
৯. অভাবগ্রস্তদেরকে যাকাত খাত থেকে কর্জে
হাসানা দেয়াও জায়েয। বরঞ্চ অভাবগ্রস্তদের অবস্থার উন্নয়নের জন্যে এবং তাদের
আপন গায়ে দাঁড়াবার সুযোগ করে দেয়ার জন্যে তাদেরকে কর্জে হাসানা দেয়া অতি
উত্তম কাজ।
১০.যেসব আত্মীয় স্বজনকে যাকাত দেয়া জায়েজ,
তাদেরকে দিলে দ্বিগুণ প্রতিদান পাওয়া যাবে। এক যাকাত দেয়ার এবং দ্বিতীয়
আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার প্রতিদান বা সওয়াব। বন্ধু বান্ধব আত্মীয়
স্বজন যাকাত গ্রহণ করতে যদি লজ্জাবোধ করে অথবা অভাবগ্রস্ত হওয়া স্বত্বেও
যাকাত নেয়া খারাপ মনে করে, তাহলে তাদেরকে একথা বলা ঠিক নয় এ যাকাতের টাকা
বা বস্তু। কারণ হকদারকে যাকাতের কথা বলে শর্ত নয়। উৎকৃষ্ট উপায় এই যে, কোনো
ঈদের পূর্বে অথবা বিয়ে শাদীতে সাহায্য বা উপঢৌকন স্বরূপ অথবা অন্য কোনো
প্রকারে যাকাত তাদেরকে পৌছিয়ে দিতে হবে।
১১. চাঁদ মাস হিসেবে যাকাত হিসেবে করে
দিয়ে দেয়া ভালো। তবে এটা জরুরী নয়। সৌর মাস হিসেবেও যাকাত দেয়া যায়। কোনো
বিশেষ মাসে যাকাত দিতে হবে তাও জরুরী নয়। কিন্তু যেহেতু রমযান মাস মুবারক ও
বেশী নেকী করার মাস এবং সওয়াব বেশী গুণে পাওয়া যায়, সে জন্যে এ মাসে যাকাত
দেয়া সবচেয়ে ভালো। তাই বলে এমন করা ওয়াজিব নয়। যাকাত আদায়ের এ কোনো শর্তও
নয়।
১২. সাধারণভাবে এটাই ন্যায়সঙ্গত যে, এক
অঞ্চলের যাকাত সেই অঞ্চলেই ব্যয় বা বণ্টন করা। কিন্তু অন্য অঞ্চলেও বিশেষ
প্রয়োজনে দেয়া যায়। যেমন বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন অন্য এলাকায় বাস করে
এবং তারা অভাবগ্রস্ত অথবা অন্য এলাকায় কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিয়েছে
এমন অবস্থায় সেসব এলাকায়ও যাকাত পাঠানো যায়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে
প্রথম এলাকা বা বস্তির কোনো দুঃস্থ লোক যেন বঞ্চিত না হয়।
১৩. যাকাত আদায় হওয়ার জন্যে এটাও শর্ত যে,
যাকে যাকাত দেয়া যাবে তাকে যাকাতের মালিক বানাতে হবে এবং যাকাত তার হস্তগত
হতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি খানা তৈরী করে হকদারকে খাইয়ে দিলো, তাহলে সে
যাকাত সহীহ হবে না। হা খানা তৈরী করে তার হাতে দিয়ে তাকে যদি এ এখতিয়ার
দেয়া হবে যে, সে তা নিজেও খেতে পারে কিংবা অন্যকে খাওয়াতে অথবা যা খুশি তোই
করতে পারে, তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। কোনো সংস্থা বা বায়তুলমালকে যাকাত
দিলেও মালিক বানাবার শর্ত পূরণ হয়ে যায়। এভাবে যাকাত সংগ্রহ বা আদায়কারীকে
দিয়ে দিলেও মালিক বানাবার শর্ত পূর্ণ হয়। তারপর বায়তুলমাল অথবা যাকাত
আদায়কারীর দায়িত্ব এসে গেল। যাকাত দাতার এ দায়িত্ব নয় যে, হকদারকে পুনরায়
মালিক বানিয়ে দেবে।
১৪. যদি কোনো ব্যক্তি নিজের কোনো আত্মীয়,
বন্ধু অথবা যে কোনো লোকের পক্ষ থেকে যাকাত দিয়ে দিলে তা হয়ে যাবে। যেমন
স্বামী তার স্ত্রীর গহনা প্রভৃতির যাকাত নিজের কাছ থেকে দিয়ে দিলে স্ত্রীর
যাকাত দেয়া হয়ে যাবে।
একবার নবী পাক (স) এর চাচা হযরত আব্বাস
(রা) নবীর নিযুক্ত যাকাত আদায়কারী হযরত ওমর (রা) কে যাকাত দিলেন না। তাতে
নবী (স) বললেন, তার যাকাত আমার দায়িত্ব। বরঞ্চ তার চেয়েও বেশী। ওমর তুমি
বুঝ না যে, চাচা পিতার সমতুল্য। (মুসলিম)
মালিকানা দানের প্রসঙ্গ
হানাফী আলেমগণের মতে যাকাত সহীহ হওয়ার
অনিবার্য শর্ত হচ্ছে, অন্যকে মালিক না বানালে যাকাত আদায় হবে না।এ প্রসঙ্গে
আল্লামা মওদূদী বিশদ টীকা লিখেছেন যা মালিক বানাবার প্রসঙ্গ উপলব্ধি করার
জন্য অত্যন্ত সহায়ক। নিম্নে তার দূর দৃষ্টিমূলক টীকা বা মন্তব্য দেয়া হলোঃ
আল্লাহ তায়ালার এরশাদ হচ্ছে:
সদকা তো গরীব দুঃখীদের জন্যে এবং
মিসকিনদের জন্যে। তাদের জন্যেও যারা এর জন্যে কাজ করে এবং তাদেরও জন্যে
যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্যে। (সূরা আত তাওবাঃ ৬০)
লক্ষ্য করুন এখানে লামের কার্যকারিতা
শুধুমাত্র গরীব দুঃখীর ওপর নয়। বরঞ্চ মিসকিন, যাকাত ব্যবস্থাপনার কর্মচারী
এবং মুয়াল্লাফাতে কুলুবুহুম (যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য) এর ওপরও বটে। এ লাম
মালিক বানিয়ে দেবার জন্য অধিকার দেয়ার জন্য। অথবা বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করে
দেয়ার জন্য হোকে এবং অন্য যে কোনো অর্থেই হোক, মোটকথা যে অর্থেই গরীব
দুঃখীর জন্যে সম্পৃক্ত হবে, ঐ অর্থে বাকী তিন প্রকার লোকের জন্যেও হবে। এখন
হানাফীদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী যদি লাম তামলিক বা মালিকানা দানের দাবী করে
তাহলে যাকাত এবং ওয়াজিব সদকার মাল এ চার প্রকারের লোকের যে কাউকেই দেয়া হোক
তাতে মালিকানা দানের দাবী পূরণ হয়ে যায়। তারপর আবার বার বার মালিকানা
প্রদানের হুকুম কোথা থেকে বের হয়? ফকির মিসকিনদের মালিকানায় যাকাতের মাল
পৌঁছে যাওয়ার পর তা ব্যয় করার ব্যাপারে কোন বাধা নিষেধ আছে নাকি? যদি না
থাকে তাহলে যাকাত ব্যবস্থাপনার কর্মচারীদের …………. হাতে যাকাত পৌঁছে যাওয়ার
পর মালিক বানিয়ে দেয়ার ইলামের দাবী যেহেতু পূরণ হয়ে যায়, সে জন্য পুনরায়
মালিক বানিয়ে দেয়ার বাধ্যবাধকতার যুক্তি কি হতে পারে? লামকে যদি মালিকানা
প্রদানের অর্থেই গ্রহণ করা হয়,তাহলে এক ব্যক্তি যখন যাকাত ও ওয়াজিব সদকার
মাল যাকাত বিভাগরে কর্মচারীদের হাতে তুলে দেয়, তখন সে তো বলতে গেলে তাদেরকে
তার মালিক বানিয়ে দিল এবং এ মাল এভাবে তাদের মালিকানা ভুক্ত হয়ে গেল যেমন
ফাই ও গণিমতের মাল সরকারের (ইসলামী রাষ্ট্রের) মালিকানাভুক্ত হয়ে যায়।
তারপর তাদের ওপর এ বাধ্যবাধকতা আর থাকে না যে, পরে সেসব মাল তারা যেসব
হকদারের ওপর ব্যয় করবে তা মালিকের আকারেই করবে। বরঞ্চ তাদের এ অধিকার রয়েছে
যে, অবশিষ্ট সাতটি যাকাতের খাতে যেভাবে মুনাসিব এবং প্রয়োজন বোধ করবে খরচ
করবে তামলিকে লামের দৃষ্টিতে (মালিক বানানোর যে শর্ত সে দিক দিয়ে) তাদের
ওপর কোন বাধা নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে না। অবশ্যি যে বাধা নিষেধ আরোপ করা
যেতে পারে তা শুধু এই যে, যে ব্যক্তিই যাকাত সংগ্রহ এবং বণ্টনের কাজ করবে
সে তার কাজের পারিশ্রমিক নেবে। অবশিষ্ট মাল সে অন্যান্য হকদারের জন্যে ব্যয়
করবে। এজন্যে যে, এসব লোককে যাকাত বিভাগের কর্মচারী হওয়ার কারণে ওসব মালের
মালিক বানিয়ে দেয়া হয় স্বর হকদার হওয়ার দিক দিয়ে নয়। …… যাকাত আদায় ও
বণ্টনের কর্মচারী শব্দগুলো স্বয়ং সে উদ্দেশ্য প্রকাশ করে যার জন্য যাকাত
তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। অতপর এ শব্দগুলো এটাও নির্ধারিত করে দেয় যে,
কর্মচারী হিসেবে এ মারের কত অংশ বৈধভাবে নিজের জন্যে ব্যয় করার অধিকার
রাখে।
এ বিশ্লেষণের পর সেই হাদীসের প্রতি
দৃষ্টি দেয়া যাক যা ইমাম আহমদ (র) হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা) থেকে বর্ণনা
করেছেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (স) এর খেদমতে হাযির হয়ে আরয
করলো-
আপনার প্রেরিত কর্মচারীকে যখন আমি যাকাত দিয়ে দিলাম তখন আমি আল্লাহ এবং তার রাসূলের কাছে দায়মুক্ত হলাম তো?
নবী (স) জবাবে বললেনঃ
হ্যাঁ তুমি যখন তা আমার প্রেরিত কর্মচারীর
হাতে তুলে দিলে তখন তুমি আল্লাহ ও তার রাসূলের কাছে দায়মুক্ত হয়ে গেলে। এ
প্রতিদান তোমার জন্য রয়েছে। যে নাজায়েয ভাবে তা ব্যয় করবে তার গোনাহ তার
হবে।
এর থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে,
যাকাতদাতা তার যাকাত …….. যাকাত কর্মচারীর হাতে তুলে দিয়ে দায়মুক্ত হয়ে
যায়। অন্য কথায় যেভাবে ফকীর মিসকিনের যাকাত দলে মালিক বানাবার শর্ত পূরণ
হয়, ঠিক তেমনি …………. কে দিলেও তা পূরণ হয়ে যায়।
এখন একথাও বুঝে নেয়া দরকার যে, ………… এর
শব্দগুলো যা কুরআনে বলা হয়েছে, তা কোন কোন লোকের ওপর প্রযোজ্য হয়। লোক তা
শুধু ঐসব কর্মচারী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ মনে করে যাদেরকে ইসলামী সরকার নিযুক্ত
করেন। কিন্তু কুরআন পাকের শব্দগুলো সাধারণভাবে বলা হয়েছে যা প্রত্যেক ঐ
ব্যক্তির উপর প্রযোজ্য হতে পারে যে যাকাত আদায় ও বণ্টনের কাজ করে। সাধারণ
অর্থে ব্যবহার্য এই শব্দগুলোকে বিশেষ অর্থে ব্যবহারে কোন যুক্তি আমার জ্ঞান
বুদ্ধিতে নেই। যদি কোন ইসলামী সরকার না থাকে অথবা আছে কিন্তু তার দায়িত্ব
সম্পর্কে উদাসীন এবং মুসলমানদের কোন একটি দল এ কাজ করার জন্য মাছে নামলো।
তাহলে কোন যুক্তি বলে একথা বলা যেতে পারে যে, না তোমরা আমার দৃষ্টিতে এতো আল্লাহর এক রহমত যে (যাকাত কর্মচারী) সরকারের জন্য নির্দিষ্ট
করার পরিবর্তে তাঁর হুকুম এমন সাধারণ শব্দ দিয়েছন যে, তার ফলে এ অবকাশ পায়
যে, ইসলামী সরকারের অবর্তমানে অথবা কর্তব্যে অবহেলাকারী সরকার বিদ্যমান
থাকলেও মুসলমান নিজেদের পক্ষ থেকে যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের জন্য বিভিন্ন
ব্যবস্থাপনা করতে পারে। যদি আল্লাহ তায়ালার এ সাধারণ হুকুমকেই সাধারণই
থাকতে দেওয়া হয়। তাহলে গরীব ছাত্রদের শিক্ষা, এতিমদের প্রতিপালন, বৃদ্ধ
অপারগ ও পঙ্গু ব্যক্তিদের দেখাশুনা, দুস্থ রোগীদের চিকিৎসা এবং এধরনের
অন্যান্য কাজের জন্য যেসব সংস্থা কাজের জন্য সে সবের ব্যবস্থাপকগন একেবারেই
ন্যয়সঙ্গতভাবেই এর পর্যায়ে পড়বে। ফলে তাদের
যাকাত গ্রহণ করার এবং প্রয়োজন অনুসারে খরচ করার এখতিয়ার থাকবে। এমনিভাবে
এমন ধরনের সংস্থা কায়েম করারও অবকাশ থাকবে যা বিশেষভাবে যাকাত সংগ্রহ ও
বণ্টনের জন্য কায়েম করা হবে। তাদের ব্যবস্থাপকও বলে গণ্য হবে। এবং যাকাত বণ্টন করার ব্যাপারে তামলিকের ফতোয়া
দ্বারা তাদের হাত বাধার প্রয়োজন থাকবে না।
আমার দৃষ্টিতে যদি কুরআনের শব্দগুলোকে
সাধারণ অর্থে রাখা যায় তাহলে উপরোক্ত (যাকাত
কর্মচারী ও ব্যবস্থাপকদের) এর উপরই তা প্রযোজ্য হবে না। বরঞ্চ অন্যান্য বহু
কর্মচারীও এর সংজ্ঞায় পড়বে। যেমন একজন এতিমের অলী, একজন রোগী ও পঙ্গু
ব্যক্তর দেখাশুনা করার লোক এবং একজন অসহায় ব্যক্তির সেবা শুশ্রূষাকারী
ব্যক্তিও আমেল যাকাত কর্মী। যাকাত সংগ্রহ করে ঐসব লোকের প্রয়োজন পূরণ করার
তার অধিকার রয়েছে। প্রচলিত পন্থায় তার কাজের পারিশ্রমিক সে নিতে চাইলেও
নিতে পারবে।
যাকাতের টাকা পয়সা যদি এক স্থান থেকে অন্য
স্থানে নেওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে তার জন্য ডাক খরজ এবং ব্যাংকের পারিশ্রমিক
ও তার থেকে দেওয়া যেতে পারে। কারণ তারাও খেদমত করার সময় পর্যন্ত (যাকাতের কর্মচারী) বলে বিবেচিত হবে।
যাকাত আদায় করতে, যাকাতের মাল একস্থান
তেকে অন্য স্থানে নিয়ে যেতে অথবা যাকাতের হকদারদের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের
জন্যে রেলগাড়ি, বাস, টাঙ্গা, ঠেলাগাড়ি প্রভৃতি যা কিছু ব্যবহার করা হবে, সে
সবের ভাড়া যাকাত থেকে দেয়া যেতে পারে। কারণ এসব খেদমত করার সময় এ সবই (যাকাত কর্মচারী) এর মধ্যে গণ্য হবে।
যাকাতের হকদারদের জন্যে যত প্রকার
কর্মচারী ও মজুর কাজে লাগেনা হবে তাদের বেতন ও পারিশ্রমিক যাকাত খাত থেকে
দেয়া যেতে পারে। কারণ তারা সব (যাকাত
কর্মচারী) এর মধ্যে গণ্য হবে।
যাকাতের হকদারের জন্যে যত প্রকার কর্মচারী
ও মজুর কাজে লাগানো হবে তাদের বেতন ও পারিশ্রমিক যাকাত খাত থেকে দেয়া যেতে
পারে। কারণ তারা সব এর মধ্যে গণ্য হবে। কেউ
রেলওয়ে ষ্টেশনে খাদ্য শস্যের বস্তা নিয়ে গেলে, কেউ দরিদ্র রোগীদের খেদমতের
জন্যে গাড়ী চালালে অথবা কেউ এতিম শিশুদের দেখাশুনো করলে তারাও ঐ পর্যায়ে
পড়বে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, (যাকাত কর্মচারীগণ যে খরচ পত্রাদি করবে তার মধ্যে এমন কোন
বাধা নিষেধ আছে নাকি যে, তারা যাকাতের হকদারের খেদমতের জন্য কোন ঘর-দোর
বানাতে পারবে না এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন, গাড়ী, ঔষধ-পত্র,
যন্ত্রপাতি, কাপড় প্রভৃতি খরিদ করতে পারবে না? আমি একথা বলি যে, হানাফীগণ এ
আয়াতের যে ব্যাখ্যাদান করেছেন তার দৃষ্টিতে এ বাধা নিষেধ শুধুমাত্র তাদের
জন্যে যারা যাকাত দেয়। তারা স্বয়ং নিঃসন্দেহে এ ধরনের কোনো খরচ-পত্রাদি
করতে পারে না। তাদের কাজ হলো এই যে, আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী যাকাত
যাদের জন্যে তাদের অথবা তাদের মধ্যে কারো মালিকানায় তা দিয়ে দেবে। এখন রইলো
**********আরবী ************ (যাকাত কর্মচারী)এর ব্যাপারে তো তাদের বেলায় এ
ধরনের কোনো বাধা নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে না। তারা যাকাতের সকল হকদারদের
জন্যে আপন স্থানে অলী বা উকিল। প্রকৃত হকদার এ মাল থেকে যেভাবে খরচপত্র
করতে পারে, সে সমুদয় খরচপত্রও তারা তাদের অলী অথবা উকিল হিসেবে করতে পারে।
তারা যখন ফকীর মিসকিনদের প্রয়োজনে কোনো ঘর দোর তৈরী করে অথবা কোনো যানবাহন
খরিদ করে তখন তা যেন ঠিক এমন যে, বহু ফকীর মিসকিন প্রত্যেকে আলাদা আলাদা
যাকাত পাওয়ার পর সম্মিলিতভাবে কোনো ঘর দোর তৈরী করলো অথবা কোনো যানবাহন
খরিদ করলো, যেসব খরচপত্রাদী করার জন্যে তাদের ওপর কোনো বাধা নিষেধ নেই।
যাকাত কর্মচারীদেরকে **********আরবী ************ যাকাত দেয়ার পন্থা আল্লাহ
তায়ালা এজন্যে নির্ধারণ করেছেন এবং তাদের হাতে যারা যাকাত দেয় তাদেরকে
আল্লাহর রাসূল এজন্যে ফরয থেকে দায়মুক্ত বলে ঘোষণা করেছেন যে, তাদেরকে এ
মাল দেয়ার অর্থ সকল হকদারকে নিয়ে দেয়া। তারা হকদারদের পক্ষ থেকেই যাকাত
সংগ্রহ করে এবং তাদের প্রতিনিধি ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তা খরচ করে। তাদের
খরচপত্রের ব্যাপারে এ দিক দিয়ে অবশ্যই আপত্তি ও অভিযোগ করা যেতে পারে যে,
তারা অমুক খরচ অপ্রয়োজনে করেছে অথবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করেছে অথবা আপন
পারিশ্রমিক প্রচলিত হার থেকে অধিক নিয়েছে অথবা কর্মচারীকে প্রচলিত হার
থেকে অধিক পারিশ্রমিক দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমার জানা মতে শরীয়াতের এমন কোনো
কায়দা কানুন নেই যার ভিত্তিতে একথা বলা যেতে পারে যে, অমুক অমুক খরচ করা
যাবে আর অমুক অমুক খরচ করা যাবে না। যাকাতের হকদারদের জন্য প্রয়োজনীয় যে
কোন কাজ করার অনুমতি শরীয়াত তাদেরকে দিয়েছে। (তরজুমানুল কুরআন ডিসেম্বর,
১৯৫৪)
যাকাতের নেসাব
যাকাতের নেসাব বলতে বুঝায় মূলধনের সেই
সর্বনিম্ন পরিমাণ যার ওপর শরীয়াত যাকাত ওয়াজিব করে। যে ব্যক্তির কাছে নেসাব
পরিমাণ মূলধন থাকবে তাকে সাহেবে নেসাব বলা হয়।
অর্থনৈতিক ভারসাম্য
যাকাতের অন্যতম বুনিয়াদী উদ্দেশ্য হলো
অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি করা। ধন আবর্তনশীল রাখার জন্য এবং সমাজের সকল
শ্রেণীর সুবিধা ভোগের জন্যে ধনশালী ও পুঁজিপতিদের নিকট থেকে যাকাত নেয়া হয়
এবং দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। নবী করীম (স) বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা লোকের
ওপর সদকা (যাকাত) ফরয করেছেন। তার নেয়া হবে ধনীদের কাছ থেকে এবং বিলিয়ে
দেয়া হবে দুঃস্থদের মধ্যে। (বুখারী, মুসলিম প্রভৃতি)
শরীয়াতের দৃষ্টিতে ধনী ও সচ্ছল তারা যাদের
কাছে নেসাব পরিমাণ মাল মওজুদ থাকে এবং বছর অতীত হওয়ার পরও মওজুদ থাকে।
নবীর যমানায় ঐসব লোক ধনী ও সচ্ছল ছিল যাদের কাছে খেজুরের বাগান, সোনা,
চাঁদি, গৃহপালিত পশু ছিল এবং শরীয়াত ঐসব জিনিসের একটা বিশিষ্ট পরিমাণ
নির্ধারণ করে বলে যে, অন্তত এতটুকু পরিমাণ যার কাছে মওজুদ থাকবে শরীয়তের
দৃষ্টিতে সে সচ্ছল। তার মাল থেকে সদকা আদায় করে সমাজের দুঃস্থদেরকে দেয়া
হবে। নবী (স) বলেনঃ পাঁচ ওয়াসাক ওজনের কম খেজুরের যাকাত নেই। পাঁচ উকিয়ার
কম চাঁদির যাকাত নেই এবং পাঁচ উটের কম হলে তার যাকাত নেই। (বুখারী,
মুসলিম)। ওয়াসাক ও উকিয়ার জন্যে পরিভাষা দ্রঃ
নেসাবের মধ্যে পরিবর্তনের প্রশ্ন
বর্তমান যুগে যেহেতু টাকার মূল্য অসাধারণ
ভাবে কমে গেছে এবং সোনা, চাঁদি, ও গৃহপালিত পশুর যে নেসাব নবীর যমানায়
নির্ধারিত করা হয়েছিল মূল্যের দিক দিয়ে তার মধ্যেও অসাধারণ পার্থক্য এসে
গেছে। এ জন্যে কেউ কেউ এ দাবী করেছেন যে, অবস্থার প্রেক্ষিতে যাকাতের নেসাব
সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা যাক। এ ধরনের এক প্রশ্নের জবাবে আল্লামা সাইয়েদ
আবুল আলা মওদূদী (র) বলেনঃ
খোলাফায়ে রাশেদীনের যমানার নবী (স) কর্তৃক
নির্ধারিত নেসাব ও যাকাতের হারের মধ্যে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি এবং এখন
তার কোনো প্রয়োজনও অনুভূত হয় না।আমাদের ধারণা এই যে, নবী (স) এর পরে তার
নির্ধারিত নেসাব পরিবর্তন করার এখতিয়ার কারো নেই। অবশ্যই সোনার নেসাবে
পরিবর্তন সম্ভব। কারণ যে রেওয়ায়েতে তার নেসাব বিশ মিসকাল বলা হয়েছে তার সনদ
অত্যন্ত দুর্বল (রাসায়েল ও মাসায়েল, দ্বিতীয় খন্ড, পৃঃ ১৪৪-১৪৫)
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে নেসাব এবং যাকাতের
হারে পরিবর্তন না করার হিকমত ও তাৎপর্যের ওপর আলোচনা প্রসঙ্গে আল্লামা
মওদূদী (র) বলেনঃ শরীয়াত প্রণেতা কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখারও নির্দিষ্ট
পরিমাণে রদবদল করার অধিকার আমাদের নেই। এ দ্বারা যদি একবার খুলে দেয়া হয়
তাহলে এক যাকাতেরই নেসাব ও পরিমাণের ওপর আঘাত পড়বে না। বরঞ্চ নামায, রোযা,
হজ্জ, বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার প্রভৃতি বহু বিষয় এমন আছে যার মধ্যে সংশোধন
ও রহিত করণের কাজ শুরু হয়ে যাবে এবং এর জের কোথাও গিয়ে শেষ হবে না।
উপরন্তু এ দুয়ার একবার খুলে দিলে যে ভারসাম্য শরীয়াত প্রণেতা ব্যক্তি এ
সমাজের মধ্যে সুবিচারের জন্যে কায়েম করেছেন তা খতম হয়ে যাবে। তারপর ব্যক্তি
ও সমাজের মধ্যে টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে যাবে। ব্যক্তিবর্গ চাইবে নেসাব ও
হারের মধ্যে পরিবর্তন তাদের স্বার্থ অনুযায়ী হোক এবং জামায়াত বা সমাজ চাইবে
তাদের স্বার্থ মুতাবেক হোক। বাছাইয়ের সময় এ সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।নেসাব
কমিয়ে হার বাড়িয়ে যদি কোনো আইন প্রণয়ন করা হয় তাহলে যাদের স্বার্থে আঘাত
লাগবে তারা তা সন্তুষ্টচিত্তে দেবে না যা দেয়া ইবাদাতের আসল স্পিরিট। বরঞ্চ
ট্যাক্সের মতো জরিমানা মনে করে দেবে এবং তারপর দিতে নানা বাহানা ও অবহেলা
করবে। এখন যেমন আল্লাহ ও রসূলের হুকুম মনে করে প্রত্যেক ব্যক্তি মাথা নত
করে এবং ইবাদাতের প্রেরণাসহ সন্তুষ্টচিত্তে যাকাতের টাকা বের করে দেয়, তা
আর অবশিষ্ট থাকবে না। যদি আইন সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য তাদের ইচ্ছামতো কোনো
নেসাব এবং কোনো হার অপরের ওপর চাপিয়ে দেয়। (রাসায়েল ও মাসায়েল, দ্বিতীয়
খন্ড, পৃঃ ১৫৭)
0 comments:
Post a Comment